উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে, রাজশাহীর হেদাতীপাড়ায় ছিল না কোনো শিক্ষালয়, আর ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ তো ছিলই না। সেই সময়, যেখানে দরিদ্রতা ছিল প্রকট এবং মানুষ জীবন যাপন করতে লড়াই করছিল, সেখানে শিক্ষার আলো একদমই অনুপস্থিত ছিল। এ পরিস্থিতিতেই স্থানীয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, জনাব মুহসিন শেখ, এলাকার উন্নয়নের জন্য একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পরিকল্পনা করেন।
তার এই মহৎ উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ একত্রিত হন। তাদের সহযোগিতায় ১৯৬৩ সালে বসন্তের প্রথম সুরে, পাখির কলতানে ভেসে আসে দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর। এই উদ্যোগের প্রথম শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন মাওলানা ইসহাক সাহেব, যিনি মাসিক ২০ টাকায় শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ফলে কিছুদিন মাদরাসাটি বন্ধ হয়ে যায়, তবে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রতিষ্ঠানটি আবার নতুন উদ্যমে চালু হয়। ১৯৭৫ সালে গ্রামের মানুষদের সহায়তায় প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮০ সালে মাদরাসার জন্য জায়গা ওয়াকফ করেন এলাকার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা। পরবর্তী সময়ে, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ মাদরাসা বোর্ডের আওতাভুক্ত হয় এবং ১৯৯৯ সালে এটি এমপিওভুক্ত হয়।
প্রতিষ্ঠাতা মুহসিন সাহেবের দৃঢ় সংকল্প ছিল, তার সন্তানদের ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং একটি প্রতিষ্ঠানে সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের দারস প্রদান করা। তার এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ২০০৯ সালে তার বড় ছেলে, ড. মুযাফফর বিন মুহসিন প্রথম পদক্ষেপ নেন। এই সময়, 'দারুল হুদা' নাম পরিবর্তন করে 'দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স' নামকরণ করা হয়।
এ প্রতিষ্ঠানের উন্নতি থেমে থাকেনি। ২০১৪ সালে এখানে হিফয বিভাগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম ছাত্রদের নিয়ে ক্লাস শুরু হয়। ২০১৬ সালে পাঁচ তলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, যা ২০১۸ সালে উদ্বোধন করা হয়। একই বছরে, শায়খ মুকাররম বিন মুহসিন মাদানীকে প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ২০২০ সালে সহীহুল বুখারীর দারস অনুষ্ঠিত হয়।
২০২১ সালে, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স উত্তরবঙ্গের মধ্যে সর্বোচ্চ রেজাল্ট অর্জন করে এবং ২০২২ সালে মহিলা শাখার প্রথম দারস প্রদান করা হয়। ২০২৩ সালে এই প্রতিষ্ঠান উত্তরের আন্তঃমাদরাসা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়, যা প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের আরো একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।
আজকের দিনে, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্সে ৮ শতাধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। মাদরাসার সুবিশাল মসজিদ এবং শিক্ষা কার্যক্রম এই প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য ও মর্যাদা বহন করছে।
দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স আজ শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি এক উন্নতির প্রতীক, যা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে।